Friday, April 13, 2012

পহেলা বৈশাখ বাঙালির উৎ‍সবের দিন ৷ বাঙলা বছরকে অভিবাদন

পহেলা বৈশাখ বাঙালির উৎ‍সবের দিন ৷বাঙলা বছরকে অভিবাদন জানানোর দিন ৷এদিন গোটা বাঙালি আলোড়িত হয়, আন্দোলিত হয় ৷ রবীন্দ্রনাথ বলেন, 'প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র, দীন, একাকী ৷কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া বৃহৎ।'
সত্যই মানুষ নির্মল আনন্দ এবং সামাজিক মিলনের মধ্যদিয়ে বড় হয় ৷ প্রসারিত হয় তারা দৃষ্টির দিগন্ত। এই বড় হওয়া সার্থক হয়ে ওঠে তখনই, যখন তা ব্যাপৃত হয় জীবন জুড়ে ৷ কিন্তু আমাদের বাস্তবতা! অনেকে বলেন, অনেকটাই ভিন্ন রকমের। উৎসবের ঔদার্যকে আমরা উৎসব শেষে প্রায়শ ভুলে যাই ৷ দৈন্যের মাঝে আমরা তাকে হারিয়ে ফেলি ৷ যে কোনো উৎসবে বাঙালি অভিন্ন হয়ে ওঠে, আবার উৎসব শেষেই বিভেদ ও বিচ্ছেদ ৷ দূরে চলে যায় একে অপরের কাছ থেকে ৷
পৃথিবীর প্রায় সবদেশে, সব অঞ্চলে নববর্ষ পালনের রেওয়াজ আছে ৷ একেক দেশে একেক রীতি ৷ ইরানে সুপ্রাচীনকাল থেকে উদযাপিত হয়ে আসছে নওরোজ উৎসব ৷ প্রাচ্যের চীন, কোরিয়া, জাপানসহ গোটা দৰিণ-পূর্ব এশিয়ায় পালন করা হয়ে থাকে নববর্ষ ৷ এসব দেশে নববর্ষ আসে চাঁদের আলোয় ৷ বসন্তকালে, ইংরেজি ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে মার্চের ১৯ তারিখের যেকোনো দিন হতে পারে এই নববর্ষ ৷ এই সময়ের মধ্যে যেদিন নূতন চাঁদ উঠবে সেদিনই শুরু নতুন বছরের ৷একে বলা হয় লুনার ক্যালেন্ডার ৷চান্দ্রবর্ষ৷ আরবী হিজরি সনের সঙ্গে অবশ্য এর কোনো মিল নেই ৷একেবারেই ওদের নিজস্ব ৷দাবি করা হয়ে থাকে যে, এই লুনার ক্যালেন্ডারের উত্‍পত্তি চীনে ৷পরে এটা ছড়িয়ে পড়ে গোটা দৰিণ-পূর্ব এবং উত্তর পূর্ব এশিয়ায়, যদিও এই অঞ্চলের দেশগুলির ভাষার মধ্যে দুসত্মর ব্যবধান৷
এতদাঞ্চলে চান্দ্রবর্ষ অনুযায়ী নববর্ষ উদযাপন করা হয় একেবারেই নিজস্ব আদলে, ঐতিহ্যের বাতাবরণে ৷ আর প্রথম মাসের অর্ধেকটা জুড়ে থাকে উৎসবের আমেজ ও আয়োজন৷ পূর্ণিমার রাতে ওদের জীবনে নেমে আসে বাঁধভাঙ্গা আনন্দের বন্যা ৷ নববর্ষের দিনগুলিতে চীন, কোরিয়া, জাপান, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশে আত্মীয়তা ও পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করবার জন্য আয়োজন করা হয় পুনর্মিলনীর ৷ বিনিময় করা হয় উপহার ৷বন্ধুত্বের দিগন্ত প্রসারিত করার জন্য তারা দেশী কায়দায় আয়োজন করে নানান অনুষ্ঠানের ৷মেলাও বসে৷ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হয়৷
আমাদের বাংলা নববর্ষ আমরা পালন করি একদিন ৷ওই একদিন প্রাণের সমস্ত আবেগ দিয়ে আমরা মেতে উঠি উদযাপনে ৷একালে এই দেশে শহর এবং গ্রামের আয়োজন ও আন্তরিকতায় বেশ প্রভেদ ৷শহরাঞ্চলে খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠে পাট ভাঙ্গা পাঞ্জাবি, ফতুয়া পরে ছেলেরা এবং মেয়েরা লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরে বেরিয়ে পড়েন ৷তারা ছুটেন বৈশাখী মেলার দিকে ৷সেখানে গিয়ে ইলিশ ভাজা দিয়ে পান্তা খেয়ে একদিনের জন্য বাঙালি হওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা চলে অনেক ক্ষেত্রে ৷ পক্ষান্তরে, পল্লী বাংলায়, এখনও ধলপহরে মানুষ জেগে ওঠেন কাছে কিংবা দূরে কোথাও মেলার ঢাকের শব্দে ৷গ্রামের মানুষ এই দিন আনন্দ করেন ৷বড়রা ছোটদের আশীর্বাদ করেন ৷ছেলেমেয়েরা চাচা, মামা, খালা, খালু এবং বড় ভাইবোনদের কাছ থেকে পরবি (উৎসব উপলক্ষ্যে উপহার) পেয়ে থাকে, তা যত সামান্যই হউক না কেন ৷
উৎসবের ভেতর দিয়ে মানুষ ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ হয়, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই ৷পহেলা বৈশাখে মানুষের যে বৃহৎ সত্তা জাগরিত হয়, যে সম্প্রসারিত চেতনার উন্মেষ ঘটে ও জেগে ওঠে যে মানবিক মূল্যবোধ, প্রতিদিনের ব্যবহারিক জীবনে তার প্রতিফলন থাকা চাই ৷পহেলা বৈশাখে আমাদের প্রতীজ্ঞা হোক, কবির ভাষায়-
'অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই,
চাই মুক্ত বায়ু,
চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু ৷
.......................................
একটি বৈশাখী মেলানতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্টীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগ। গ্রামে মানুষ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, নতুন জামাকাপড় পড়ে এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যায়। বাড়িঘর পরিষ্কার করা হয় এবং মোটমুটি সুন্দর করে সাজানো হয়। বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও থাকে। কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকায়, কোন খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। মেলাতে থাকে নানা রকম কুঠির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন, থাকে নানারকম পিঠা পুলির আয়োজন। অনেক স্থানে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। এই দিনের একটি পুরনো সংস্কৃতি হলো গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। এর মধ্যে থাকে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা কিংবা কুস্তির। বাংলাদেশে এরকম কুস্তির সবচেয়ে বড় আসরটি হয় ১২ বৈশাখ, চট্টগ্রাম-এর লালদিঘী ময়দান-এ। এটি জব্বারের বলি খেলা নামে পরিচিত।
চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখে শোভাযাত্রার একটি অংশ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে পহেলা বৈশাখের মূল অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট-এর গানের মাধ্যমে নতুন বছরের সূর্যকে আহবান। পহেলা বৈশাখ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছায়ানটের শিল্পীরা সম্মিলিত কন্ঠে গান গেয়ে নতুন বছরকে আহবান জানান। স্থানটির পরিচিতি বটমূল হলেও প্রকৃত পক্ষে যে গাছের ছায়ায় মঞ্চ তৈরী হয় সেটি বট গাছ নয়, অশ্বত্থ গাছ। ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠির নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা।।
ঢাকার বৈশাখী উৎসবের একটি আবশ্যিক অঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখে সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। এই শোভাযাত্রায় গ্রামীণ জীবণ এবং আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয়। শোভাযাত্রায় সকল শ্রেণী-পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে। শোভাযাত্রার জন্য বানানো নয় রং-বেরঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিলিপি। ১৯৮৯ সাল থেকে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখের উৎসবের একটি অন্যতম আকর্ষণ।
বন্দরনগরী চট্টগ্রামে পহেলা বৈশাখের উৎসবের মূল কেন্দ্র ডিসি পাহাড় পার্ক। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে এখানে পুরোনে বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণ করার জন্য দুইদিনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মুক্ত মঞ্চে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি থবকে নানা প্রামীণ পন্যের পশরা। থাকে পান্তা ইলিশের ব্যবস্থাও।
চট্টগ্রামে সম্মিলিত ভাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের উদ্যোগ ১৯৭৩, ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সালে রাজনীতিকগণের চেষ্টায়। ইস্পাহানী পাহাড়ের পাদদেশে এই অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। ১৯৭৮ সালে এই উৎসব এখনকবর ডিসি হিল পার্কে সরিয়ে নেওযা হয়। ১৯৭৮ সালের উদ্যোগের সংগে জড়িত ছিলেন ওয়াহিদুল হক, নির্মল মিত্র, মিহির নন্দী, অরুন দাশ গুপ্ত, আবুল মোমেন সুভাষ দে প্রমূখ। প্রথম দিকে প্রত্যেক সংগঠন থেকে দুইজন করে নিয়ে একটি স্কোয়াড গঠন করা হত। সেই স্কোয়াডই সম্মিলিত সংগীত পরিবেশন করতো। ১৯৮০ সাল থেকে সংগঠনগুলো আলাদাভাবে গান পরিবেশন শুরু করে। পরে গ্রুপ থিয়েটার সমন্বয় পরিষদ যুক্ত হওয়ার পর অনুষ্ঠানে নাটকও যুক্ত হয়েছ। নগরীর অন্যান্য নিয়মিত আয়োজনের মধ্যে রয়েছে শিশু সংগঠন ফুলকীর তিনদিন ব্যাপী উৎসব যা শেষ হয় বৈশাখের প্রথম দিবসে। নগরীর মহিলা সমিতি স্কুলে একটি বর্ষবরণ মেলা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার প্রধান তিনটি ক্ষুদ্রজাতিস্বত্তা রয়েছে যাদের প্রত্যেকেরই বছরের নতুন দিনে উৎসব আছে। ত্রিপুরাদের বৈশুখ, মারমাদের সাংগ্রাই ও চাকমাদের বিজু উৎসব। বর্তমানে তিনটি জাতিস্বত্ত্বা একত্রে এই উৎসবটি পালন করে। যৌথ এই উৎসবের নাম বৈসাবি। উৎসবের নানা দিক রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো মার্মাদের পানি উৎসব।
মুক্ত দর্শন ও মুক্ত উৎসের প্রচারণাঃ ২০০৬ সাল থেকে ঢাকার পহেলা বৈশাখ উদযাপনে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক(বিডিওএসএন)-এর স্বেচ্ছাসেবকদের মুক্ত দর্শন বিষয়ে প্রচারণা। উৎসবের আমেজের সঙ্গে মিলিয়ে দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরার জন্য প্রচারণা চালানো হয় এই দিনে। স্বেচ্ছাসেবকরা শাহবাগ গণগ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হয়ে দর্শনবর্থীদের মধ্যে প্রচারপত্র বিতরণ করে। একটি শোভাযাত্রারও আয়োজন করা হয়। ২০০৮ সাল থেকে চট্টগ্রামেও অনুরূপ আযোজন চালু হয়েছি ডিসি হিল পার্কের উৎসবকে ঘিরে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মহাসমারোহে সাড়ম্বরে উদযাপিত হয় বাংলা নববর্ষারম্ভ পয়লা বৈশাখ। বঙ্গাব্দের প্রথম দিনটিতে বিপুল উৎসাহ এবং উদ্দীপনার সাথে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়ে থাকে সমগ্র পশ্চিম বাংলায়। বাংলার গ্রামীণ এবং নাগরিক জীবনের মেলবন্ধন সাধিত হয়ে সকলে একসূত্রে বাঁধা পড়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আনন্দে। সারা চৈত্র মাস জুড়েই চলতে থাকে বর্ষবরণের প্রস্তুতি। চৈত্র মাসের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তি বা মহাবিষুবসংক্রান্তির দিন পালিত হয় চড়কপূজা অর্থাৎ শিবের উপাসনা। এইদিনেই সূর্য মীন রাশি ত্যাগ করে মেষ রাশিতে প্রবেশ করে। এদিন গ্রামবাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আয়োজিত হয় চড়ক মেলা। এই মেলায় অংশগ্রহণকারীগণ বিভিন্ন শারীরিক কসরৎ প্রদর্শনপূর্বক মানুষের মনোরঞ্জন করে থাকে। এছাড়া বহু পরিবারে বর্ষশেষের দিন টক এবং তিতা ব্যঞ্জন ভক্ষণ করে সম্পর্কের সকল তিক্ততা ও অম্লতা বর্জন করার প্রতীকী প্রথা একবিংশ শতাব্দীতেও বিদ্যমান। পরের দিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ প্রতিটি পরিবারে স্নান সেরে বয়ঃজ্যেষ্ঠদের প্রণাম করে শুরু হয় দিন। বাড়িতে বাড়িতে এবং সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চলে মিষ্টান্ন ভোজন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলির অধিকাংশই এদিন থেকে তাদের ব্যবসায়িক হিসেবের নতুন খাতার উদ্বোধন করে, যার পোশাকি নাম হালখাতা। গ্রামাঞ্চলে এবং কলকাতা শহরের উপকণ্ঠে পয়লা বৈশাখ আরম্ভ হয় বৈশাখী মেলা। এই মেলা সমগ্র বৈশাখ মাস জুড়ে অনুষ্ঠিত হয়।
ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতা পয়লা বৈশাখ উদযাপনে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। নববর্ষারম্ভ উপলক্ষে শহরের রাজপথে এবং অলিতে গলিতে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা আয়োজিত হয়। বিগত বছরের চৈত্র মাসে শহরের সমগ্র দোকানে ক্রয়ের উপর দেওয়া হয়ে থাকে বিশেষ ছাড়। তাই ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে কলকাতার সমস্ত মানুষ একমাস ধরে নতুন জামাকাপড়, ইত্যাদি ক্রয় করে থাকে। পয়লা বৈশাখের দিন উল্লেখযোগ্য ভিড় চোখে পড়ে কলকাতার কালীঘাটে। সেখানকার বিখ্যাত কালীমন্দিরে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ভোর থেকে প্রতীক্ষা করে থাকেন দেবীকে পূজা নিবেদন করে হালখাতা আরম্ভ করার জন্য। ব্যবসায়ী ছাড়াও বহু গৃহস্থও পরিবারের মঙ্গল কামনা করে দেবীর আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে কালীঘাটে গিয়ে থাকেন। এইদিন বাঙালি ফিরে যায় তার ঐতিহ্যবাহী পোশাক ধুতি-পাঞ্জাবি এবং শাড়িতে। বিগত বছরের সমস্ত গ্লানি মুছে ফেলে নতুনভাবে জীবন শুরু করার ব্রত নিয়ে শেষ হয় পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান।
..........................................
পয়লা বৈশাখ বা পহেলা বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম দিন। শুভ বাংলা নববর্ষ। বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের ১ তারিখ। দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের দিন হিসেবে পালিত হয়। ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও এই উৎসবে অংশ নেয়। সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন উৎসব। বিশ্বের সকল প্রান্তের সকল বাঙালি এ দিনে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়, ভুলে যাবার চেষ্টা করে অতীত বছরের সকল দুঃখ-গ্লানি। সবার কামনা থাকে যেন নতুন বছরটি সমৃদ্ধ ও সুখময় হয়। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা একে নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করার উপলক্ষ্য হিসেবে বরণ করে নেয়। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৪ই এপ্রিল অথবা ১৫ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। আধুনিক বা প্রাচীন যে কোন পঞ্জিকাতেই এই বিষয়ে মিল রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়। বাংলা একাডেমী কর্তৃক নির্ধারিত আধুনিক পঞ্জিকা অনুসারে এই দিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এদিন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে।
বাংলা দিনপঞ্জীর সঙ্গে হিজরী ও খ্রিস্টীয় সনের মৌলিক পার্থক্য আছে। পার্থক্য হলো হিজরী সন চাঁদের হিসাবে এবং খ্রিস্টীয় সন ঘড়ির হিসাবে চলে। এ কারণে হিজরী সনে নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যায় নতুন চাঁদের আগমনে। ইংরেজি দিন শুরু হয় মধ্যরাতে। আর বাংলা সনের দিন শুরু হয় ভোরে, সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে। কাজেই সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় বাঙালির পহেলা বৈশাখের উৎসব।
ইতিহাসঃ সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারটি মাস অনেক আগে থেকেই পালিত হত। এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হত গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরল, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিল নাড়ু এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালিত হত। এখন যেমন নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, এক সময় এমনটি ছিল না। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আর্তব উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হত। তখন এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ। প্রাযুক্তিক প্রয়োগের যুগ শুরু না হওয়ায় কৃষকদের ঋতুর উপরই নির্ভর করতে হত।
ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হত। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জীতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবী হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।
আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হত। এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রুপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরী করা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হল বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাঠের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকনদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন আপ্যায়ন করে থাকে। এই প্রথাটি এখনও অনেকাংশে প্রচলিত আছে, বিশেষত স্বর্ণের দোকানে।
আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে স�
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...

ShareThis

UA-38344978-1